বিজ্ঞানের দর্শন
Science



আমরা বিজ্ঞান দর্শন (Science Philosophy) নিয়ে খুব একটা বলি না, যত না বিজ্ঞান শিক্ষা (Science Education) নিয়ে বলি। ১৬৬৬ সালে একজন তরুণ বিজ্ঞানী, যার নাম ‘আইজ্যাক নিউটন’, বাগানে দেখলেন গাছ থেকে আপেল ছুটে উপরে বা পাশে না যেয়ে নিচে পড়ছে। আর এ থেকেই বিখ্যাত ‘মহাকর্ষ তত্ত্ব’-এর আইডিয়া উনার মাথায় আসলো। (আবার এও কথিত আছে, নিউটন আগেই মহাকর্ষ তত্ত্ব সংক্রান্ত আইডিয়া পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আইডিয়াকে গুছিয়ে আনতে গাছ থেকে আপেল পড়ার মতো দৈনন্দিন উদাহরণগুলো কাজে এসেছিলো)। যাই হোক, কিন্তু এরপরে কী হলো? উনি কি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সব প্রমাণাদি হাজির করার, যাতে উনার থিওরি নিঃসন্দেহে ঠিক প্রমাণিত হয়?
.
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিজ্ঞানের দর্শনের মাথা ‘কার্ল পপার (Karl Popper, 1902-1994)’-এর মতে উত্তরটা হলো, “না”। উনার থিওরি সঠিক প্রমাণের চেষ্টা তখনই বিজ্ঞানসম্মত হবে, যখন উনি এটা ভুল প্রমাণের যত পরীক্ষা, নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণ আছে, সেগুলো করবেন। পপারের মতে কোনো থিওরি বা কোনো হাইপোথিসিস ‘বৈজ্ঞানিক’ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটায় ভুল প্রমাণের সুযোগ বা সম্ভাবনা (Falsifiability or refutability) থাকে। পপার বলেছেন যে- বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, হাইপোথিসিস ভুল প্রমাণের সম্ভাবনা “ওটার মধ্যেই (in built)” থাকতে হবে। বিজ্ঞানীরা কিছুটা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, কিছুটা অনুমান-অনুভূতি (hunch) এবং পর্যবেক্ষণ দিয়ে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করাবেন। এরপরে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন এটাকে ভুল প্রমাণের জন্য। যদি একবারও ভুল প্রমাণিত না হয়, তাহলে এটা থিওরি হিসেবে টিকে যাবে। তবে এই সম্ভাবনা নিয়ে যে, কোনো এক সময় এটা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। এই সম্ভাবনা না থাকলে, পপারের মতে, সেটা বৈজ্ঞানিক থিওরি হবে না। বিজ্ঞানীরা ভুল থেকেই শেখেন।
.
পপার এভাবে ‘বিজ্ঞান’ আর ‘অপবিজ্ঞান (Pseudoscience)’ চেনার উপায় বাতলিয়েছেন। উনার মতে অপবিজ্ঞান হলো, যেটায় ভুল প্রমাণের কোনো সুযোগ নাই। যেমন ধরুন আপনি বললেন, ”সান্তা ক্লজ সত্য।“ এরপর আপনি এটা প্রমাণের জন্যে যে সব সাক্ষ্য জোগাড় করবেন, তা হলো: আপনি সান্তার থেকে উপহার পান, সান্তার ছবি সবখানে, চিরদিন মানুষ এটা বিশ্বাস করে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে অপবিজ্ঞানীরা অপবিজ্ঞানের পক্ষের সব সাক্ষ্য খুঁজতে থাকবেন। কোনো বিশ্বাসও (Belief System) পপারের মতে অবৈজ্ঞানিক, কারণ প্রথমেই এটাতে ভুল প্রমাণের সুযোগ নাই।
.
পপার সাদা আর কালো রাজহাঁসের উদাহরণ দিয়েছেন, “...no matter how many instances of white swans we may have observed, this does not justify the conclusion that all swans are white.”
আপনি যদি বলেন “সব রাজহাঁসই সাদা“, তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণের জন্য আপনি শুধু সাদা রাজহাঁসই পর্যবেক্ষণ করবেন না। এক মিলিয়ন সাদা রাজহাঁসের মধ্যে একটা মাত্র কালো রাজহাঁস এর পর্যবেক্ষণই এই “সব রাজহাঁস সাদা” কথাটা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণ করবে।
.
এক সময়ে ভাবা হতো, আমরা যা কিছু দেখার দেখি। তারপর একটা বৈজ্ঞানিক আইডিয়া দেই। এরপরে সব এভিডেন্স যোগাড় করি এটা সঠিক প্রমাণের জন্য। পপার এই পজিটিভিস্টদের আইডিয়াতে একটা বড় ধাক্কা ছিলেন। উনি ‘Volume of Knowledge’ , ‘induction’ আর ‘deduction’ এর মধ্যে পার্থক্য সহ আরো অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সাধারণভাবে মনে রাখার মতো আলোচনাটা হলো (যেটা এখানে বললাম) যে - কীভাবে বিজ্ঞান নিজেই তার জগতের একটা আইডিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে, ভুল প্রমাণের পরীক্ষা করে। যদি ভুল প্রমাণিত না হয়, তখন সেই মুহূর্ত পর্যন্ত সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য। এভাবেই আমরা সবসময় শুধু ‘সত্যের কাছাকাছি’ যেতে পারি।
.
পপার আইনস্টাইনের সমসাময়িক। আইনস্টাইনের কাজের ধারাকে পপার গভীরভাবে দেখেছেন। আইনস্টাইনের লেকচার উনি উপস্থিত থেকে শুনেছেন। পপার লক্ষ্য করেছেন যে, আইনস্টাইন অতীতের দিকে না যেয়ে, আর অতীতের ডাটা ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানকে অনুমান (Predict) না করে বরং সামনের দিকে তাকিয়েছেন, আর ভবিষ্যতকে প্রেডিক্ট করেছেন। আইনস্টাইন ১৯১৬ সালে তাঁর ‘General Theory of Relativity’ এর আইডিয়া প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন খুব ধৈর্য ধরে ১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণের পর্যবেক্ষণের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। আর ওই সূর্যগ্রহণে উনি অন্য কিছু পর্যবেক্ষণ করলে উনার এই বৈপ্লবিক থিওরি তখনি শেষ হয়ে যেতো। তাই আইনস্টাইনের থিওরি যে আলো সূর্য দিয়ে আকর্ষিত হবে, ভুল প্রমাণের সুযোগ ছিলো (Falsifiable)। আর এজন্যই এই থিওরিটা বৈজ্ঞানিক।
.
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ব্যাখ্যা পপারের চেয়ে, আমার মতে, মার্কিন দার্শনিক এবং পদার্থবিদ টমাস কুন (Thomas Kuhn, 1922-1996) পরিষ্কার দিয়েছেন । ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘The Structure of Scientific Revolution’ বইতে কুন ব্যাখ্যা করেছেন, ‘স্বাভাবিক বিজ্ঞান (Normal Science)’ কীভাবে সামনের দিকে আগায়? কুন এর মতে, বিজ্ঞানীরা একটা ফ্রেমওয়ার্কে কাজ করেন, যেটাকে উনি বলেছেন ‘প্যারাডাইম (paradigm)’। কোনো সময়ের জন্য সব বিজ্ঞানীরাই ঐ একই ফ্রেমওয়ার্কে কাজ করেন। যেমন - কোপার্নিকাসের আগে বিজ্ঞানীরা এই প্যারাডাইমে কাজ করতেন যে “সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে”। জোতির্বিজ্ঞানীরা তখন তাদের পর্যবেক্ষণ, গবেষণা সব এভাবে করতেন যে সেগুলো ওই প্যারাডাইমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কোপার্নিকাসের আইডিয়া “পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে ঘোরে” ওই প্যারাডাইমে “হিসাবের ভুল” বলে ধরা হত। এভাবে তখন “পৃথিবীর চারদিকে সূর্যের ঘোরাঘুরি”-ই ছিলো তখনকার ‘স্বাভাবিক বিজ্ঞান’।
.
কুনের মতে, বিজ্ঞান তখনই আগায়, যখন একটা প্যারাডাইম পরিবর্তিত (Paradigm shift) হয়। মানে, যখন বুঝার উপায় একেবারে পালটে যায়। বিজ্ঞানীরা যখন কোনো বিষয়ে এত এত তথ্য খুঁজে পান যে তাতে আর পুরনো প্যারাডাইমে ঐ বিষয়টার ব্যাখ্যা আঁটে না, বা বর্ণনা করা যায় না; তখন পুরনো প্যারাডাইম ভেঙ্গে নতুন আর একটা প্যারাডাইম তৈরি করতে হয়। তখনকার সময়ের ‘স্বাভাবিক বিজ্ঞান’ আবার ওই প্যারাডাইমে চলতে শুরু করে। কুনের মতে, সত্য আবিষ্কারের অপেক্ষায় বসে থাকে না; বরং কোনো এক সময়ের প্যারাডাইম, যা আমরা তখন চিন্তা করতে পারি, তা ঠিক করে (fixes) দেয়।
.
লেখাটার অনুপ্রেরনাঃ ‘A Little History of Philosophy’ by Nigel Warburton.

Post A Comment:

0 comments: